আগামী নির্বাচনের জন্য আরও চারটি বিভাগে আওয়ামী লীগের প্রার্থী চূড়ান্ত করা হয়েছে। গতকাল শুক্রবার দলের সংসদীয় মনোনয়ন বোর্ডের দ্বিতীয় দিনের বৈঠকে খুলনা, বরিশাল, ময়মনসিংহ ও ঢাকা বিভাগের ১৫১টি আসনে দলীয় প্রার্থীদের মনোনয়ন দেওয়া হয়। এদিনও বর্তমান এমপিদের কয়েকজন মনোনয়নবঞ্চিত হন। তাদের জায়গায় নতুন প্রার্থী দেওয়া হয়েছে।
এ নিয়ে দু’দিনে ছয় বিভাগের ২২৩টি আসনে দলীয় প্রার্থী নির্ধারণ করল ক্ষমতাসীন দলটি। আগের দিন বৃহস্পতিবার চূড়ান্ত হয়েছিল রংপুর ও রাজশাহী বিভাগের ৭২টি আসনের প্রার্থী। তবে প্রথম দিনের মতো গতকালও দল মনোনীত প্রার্থীদের নাম ঘোষণা করা হয়নি। এমনকি ‘কৌশলগত কারণে’ এদিন কোন কোন বিভাগের প্রার্থী চূড়ান্ত হয়েছে, সেটাও জানানো হয়নি। বলা হয়েছে, ৩০০ আসনের প্রার্থী চূড়ান্ত করার পর আগামীকাল রোববার আনুষ্ঠানিকভাবে দলের প্রার্থী তালিকা প্রকাশ করা হবে। এদিকে, আগামীকাল রোববার গণভবনে দলীয় মনোনয়নপ্রত্যাশীদের সঙ্গে মতবিনিময় সভা ডেকেছে আওয়ামী লীগ।
গতকাল শুক্রবার টানা দ্বিতীয় দিনের মতো বৈঠকে বসে আওয়ামী লীগের সংসদীয় মনোনয়ন বোর্ড। এদিন দু’দফা বৈঠক হয়। সকাল ১০টায় শুরু হয়ে তিন ঘণ্টারও বেশি চলা প্রথম বৈঠকে খুলনা ও বরিশাল বিভাগের ৫৭টি এবং সন্ধ্যা থেকে রাত প্রায় ১০টা পর্যন্ত আরেক দফা বৈঠকে বসে ময়মনসিংহ ও ঢাকা বিভাগের ৯৪টি আসনে দলীয় প্রার্থী চূড়ান্ত করা হয় বলে বৈঠক সূত্রে জানা গেছে। বৈঠকে সভাপতিত্ব করেন আওয়ামী লীগ সভাপতি ও দলের সংসদীয় মনোনয়ন বোর্ডের সভাপতি শেখ হাসিনা।
আজ শনিবার সকাল ১০টা থেকে সংসদীয় মনোনয়ন বোর্ডের তৃতীয় দিনের বৈঠক বসবে। সেখানে সিলেট ও চট্টগ্রামের দলীয় প্রার্থী চূড়ান্ত করার কথা রয়েছে। এ দুই বিভাগের আসন সংখ্যা ৭৭।
প্রথম দফার বৈঠক শেষে বিকেলে দলীয় সভাপতি শেখ হাসিনার ধানমন্ডির রাজনৈতিক কার্যালয়ে প্রেস ব্রিফিংয়ে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেন, কৌশলগত কারণে আজ কোন কোন বিভাগের মনোনয়ন চূড়ান্ত হয়েছে, তা আর প্রকাশ করা হচ্ছে না। একসঙ্গে ৩০০ আসনের প্রার্থী তালিকা প্রকাশ করা হবে। শনিবার সম্ভব না হলে রোববার এ তালিকা প্রকাশ করা হবে।
তিনি বলেন, আমরা যখন বিভাগের নাম ঘোষণা করি, তখন ভিড় বেড়ে যায়। নির্দিষ্ট বিভাগ শুনলে পীড়াপীড়ি শুরু হয়ে যায় কীভাবে নাম বের করা যায়। সে কারণে বিভাগের নাম ঘোষণা করছি না। আমরা দলীয় মনোনয়নের ব্যাপারটাও সুনির্দিষ্ট করে এখনই বলছি না। কারণ এর মধ্যে আমরা যেসব প্রার্থী দিয়েছি, সেসব মনোনয়নে ভুলত্রুটিও থাকতে পারে। সেটাও সংশোধনের একটা সুযোগ রেখেছি। এ কারণে আমরা ঠিক করেছি, ভিন্নভাবে জেলাওয়ারি বা বিভাগওয়ারি প্রার্থিতা ঘোষণা করব না। একসঙ্গে ৩০০ আসনের প্রার্থিতা ঘোষণা করতে চাই।
ওবায়দুল কাদের আরও বলেন, আজকের সভায়ও কিছু পুরোনো এমপি বাদ গেছেন; নতুনরাও মনোনয়ন পেয়েছেন। সম্ভাব্য জয়ী প্রার্থী আমরা বাদ দিইনি।
দলীয় মনোনয়নের ক্ষেত্রে বর্তমান এমপিদের বাদ পড়ার কারণ সম্পর্কে তিনি বলেন, যারা সম্ভাব্য জয়ী কিংবা জয়ের সম্ভাবনা নেই এবং জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্যতা হারিয়ে ফেলেছেন, তারাই বাদ পড়ছেন। নারী-পুরুষ সব প্রার্থীর মনোনয়নের ক্ষেত্রেই এটা প্রযোজ্য।
আওয়ামী লীগের সংসদীয় মনোনয়ন বোর্ডের বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন আমির হোসেন আমু, তোফায়েল আহমেদ, ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন, শেখ ফজলুল করিম সেলিম, আবুল হাসানাত আবদুল্লাহ, কাজী জাফরউল্লাহ, রমেশ চন্দ্র সেন, ওবায়দুল কাদের, রশিদুল আলম এবং ডা. দীপু মনি। দাপ্তরিক কাজের প্রয়োজনে দলের প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক ড. আবদুস সোবহান গোলাপ, দপ্তর সম্পাদক ব্যারিস্টার বিপ্লব বড়ুয়া এবং উপদপ্তর সম্পাদক সায়েম খান বৈঠকে যোগ দেন।
তালিকা প্রকাশে কঠোর গোপনীয়তা
আগের দিনের মতো গতকালও চূড়ান্ত হওয়া প্রার্থী তালিকা প্রকাশের ক্ষেত্রে কঠোরভাবে গোপনীয়তা রক্ষা করা হয়েছে। এমনকি মনোনয়ন বোর্ডের সদস্যরাসহ বৈঠকে উপস্থিত নেতারাও সাংবাদিক ও মনোনয়নপ্রত্যাশীদের কাছে এ বিষয়ে মুখ খোলেননি। গতকালও অনেকের ফোন বন্ধ পাওয়া গেছে।
তবে বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, গতকাল চূড়ান্ত হওয়া চার বিভাগের আসনগুলোর বেশির ভাগ আসনেই বর্তমান এমপিদের ফের মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে। কয়েকজন বাদ পড়েছেন। জনপ্রিয়তা হারানোসহ নানা বিতর্কিত কর্মকাণ্ডে জড়িত হওয়ায় এসব এমপি এবার দলীয় মনোনয়নের জন্য বিবেচনায় আসেননি। তাদের জায়গায় কয়েকজন তরুণ নেতাকে দলের মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে।
দলীয় সূত্রগুলো বলছে, আসন্ন জাতীয় নির্বাচনের জন্য ৩০০ আসনেই প্রার্থী মনোনয়ন দিয়ে রাখছে আওয়ামী লীগ। এমনকি ১৪ দলীয় জোট শরিক এবং মহাজোটের শরিক জাতীয় পার্টির এমপিদের আসনেও দলীয় প্রার্থী চূড়ান্ত করা হচ্ছে। পরে জোটগত আসন সমঝোতা হলে শরিক দলগুলোকে ছাড় দেওয়া আসন থেকে দলীয় প্রার্থীদের প্রত্যাহার করে নেওয়া হবে। জাতীয় পার্টির সঙ্গে সমঝোতার বিষয়টি এখন পর্যন্ত একরকম অনিশ্চিত থাকায় একাদশ সংসদের প্রধান বিরোধী দলের এমপিদের আসন বিষয়ে আওয়ামী লীগের অবস্থান এখনও পরিষ্কার হয়নি। জাতীয় পার্টি এরই মধ্যে এককভাবে ৩০০ আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতার সিদ্ধান্ত নিয়ে আলাদাভাবে প্রার্থী বাছাই শুরু করেছে।
নানা গুঞ্জন, প্রার্থীরাও দোলাচলে
গতকাল চূড়ান্ত হওয়া আসনগুলোর প্রার্থী নিয়ে নানা গুঞ্জন চলছে। মনোনয়ন চূড়ান্ত হয়েছে বলে শোনা যাচ্ছে, এমন প্রার্থী এবং তাদের সমর্থকরাও নানা দোলাচলে ভুগছেন। এখন মনোনয়ন দেওয়া হলেও পরে বাদ পড়েন কিনা– এমন দুশ্চিন্তাও দেখা দিয়েছে অনেকের মধ্যে। আবার বিভিন্ন মাধ্যমে একই আসনে একাধিক ব্যক্তির পক্ষে মনোনয়ন পাওয়ার দাবি করায় এ নিয়ে বিভ্রান্তিও দেখা দিয়েছে নেতাকর্মীর মধ্যে। অনেক প্রার্থীর মনোনয়ন নিশ্চিত হওয়ার দাবি করে বিভিন্ন এলাকায় কর্মী-সমর্থক মিষ্টি বিতরণ করেছেন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে অভিনন্দনের বন্যা বয়ে গেছে।
তবে এখন অনেক প্রার্থীর নাম চূড়ান্ত হলেও দলীয় মনোনয়ন বোর্ডের প্রধান হিসেবে শেখ হাসিনা চূড়ান্ত পর্যায়ে এই প্রার্থী তালিকায় রদবদল আনতে পারেন বলেও জানিয়েছে দলীয় সূত্রগুলো।
শুক্রবার সংসদীয় মনোনয়ন বোর্ডের বৈঠকে মনোনয়নপ্রাপ্তদের মধ্যে জাতীয় ক্রিকেট দলের অধিনায়ক সাকিব আল হাসান মাগুরা-১ এবং চিত্রনায়ক ফেরদৌস ঢাকা-১০ আসন থেকে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়েছেন বলে জানা গেছে। এ ছাড়া ঢাকা-১৩ আসনে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য অ্যাডভোকেট জাহাঙ্গীর কবির নানক, যশোর-২ আসনে দলের বর্ষীয়ান নেতা ও সাবেক বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদের জামাতা ডা. তৌহিদুজ্জামান তুহিন, বরিশাল-২ আসনে তালুকদার মোহাম্মদ ইউনুস এবং বরিশাল-৪ আসনে ড. শাম্মী আহমেদ মনোনয়ন পেয়েছেন। এসব আসনের পুরোনো এমপিরা বাদ পড়েছেন বলে জানা গেছে।
অন্যদিকে, ঢাকা-৬ আসনে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র মোহাম্মদ সাঈদ খোকন, ঢাকা-৮ আসনে দলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম এবং ঢাকা-৭ আসনের বর্তমান এমপি হাজী মোহাম্মদ সেলিমের জায়গায় তাঁর ছেলে ইরফান সেলিমকে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে।
বিভিন্ন সূত্র থেকে পাওয়া তথ্যানুযায়ী কুষ্টিয়া-১ আসন থেকে আ কা ম সরওয়ার জাহান বাদশাহ, কুষ্টিয়া-৩ আসনে মাহবুবউল-আলম হানিফ, মাগুরা-২ আসনে ড. বীরেন শিকদার, বাগেরহাট-১ আসনে শেখ হেলাল উদ্দিন, বাগেরহাট-২ আসনে শেখ সারহান নাসের তন্ময়, বাগেরহাট-৩ আসনে হাবিবুন নাহার, খুলনা-১ আসনে পঞ্চানন বিশ্বাস, খুলনা-২ আসনে শেখ সালাহ উদ্দিন জুয়েল, খুলনা-৩ আসনে মন্নুজান সুফিয়ান, খুলনা-৪ আসনে আবদুস সালাম মুর্শেদী, খুলনা-৫ আসনে নারায়ণ চন্দ্র চন্দ, চুয়াডাঙ্গা-১ আসনে সোলায়মান হক জোয়ার্দ্দার ছেলুন, চুয়াডাঙ্গা-২ আসনে আলী আজগার টগর, মেহেরপুর-১ আসনে ফরহাদ হোসেন, মেহেরপুর-২ আসনে সাহিদুজ্জামান খোকন, ভোলা-১ আসনে তোফায়েল আহমেদ, ভোলা-২ আসনে আলী আজম মুকুল, ভোলা-৪ আসনে আবদুল্লাহ আল ইসলাম জ্যাকব, বরিশাল-১ আসনে আবুল হাসানাত আবদুল্লাহ, বরিশাল-৩ আসনে সরদার খালেদ হোসেন স্বপন, বরিশাল-৫ আসনে জাহিদ ফারুক শামীম, বরিশাল-৬ আসনে মেজর জেনারেল (অব.) হাফিজ মল্লিক, পিরোজপুর-৩ আসনে আশরাফুল ইসলাম, পটুয়াখালী-১ আসনে অ্যাডভোকেট আফজাল হোসেন, পটুয়াখালী-২ আসনে আ স ম ফিরোজ, পটুয়াখালী-৩ আসনে এস এম শাহজাদা এবং পটুয়াখালী-৪ আসনে মহিবুর রহমান মহিব দলের মনোনয়ন পেয়েছেন বলে জানা গেছে।
কাল মনোনয়নপ্রত্যাশীদের সঙ্গে মতবিনিময়ে
আগামীকাল রোববার সকাল ১০টায় আওয়ামী লীগের সকল মনোনয়নপ্রত্যাশীর সঙ্গে মতবিনিময় সভা গণভবনে অনুষ্ঠিত হবে। আওয়ামী লীগ সভাপতি ও সংসদীয় মনোনয়ন বোর্ডের সভাপতি শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে সভায় দলের জাতীয় নির্বাচন পরিচালনা কমিটির সদস্যরাও উপস্থিত থাকবেন।
দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের এক বিবৃতিতে সকল মনোনয়নপ্রত্যাশীকে জাতীয় পরিচয়পত্রের ফটোকপি, মনোনয়নপত্রের রিসিভ কপি এবং প্রযোজ্য ক্ষেত্রে অনলাইন ফরমের ফটোকপিসহ সভায় উপস্থিত থাকার আহ্বান জানিয়েছেন।
এর আগে ৩০০ আসনের জন্য ৩ হাজার ৩৬২টি দলীয় মনোনয়ন ফরম বিক্রি ও জমা হয়েছিল।
প্রেস ব্রিফিংয়ে যা বললেন ওবায়দুল কাদের
মনোনয়ন বোর্ডের বৈঠকের পর প্রেস ব্রিফিংয়ে দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের আরও বলেন, বিএনপি নির্বাচনে আসবে না, এটা এক কথায় উড়িয়ে দেওয়া যাবে না। তাদের এখনও নির্বাচনে আসার সুযোগ আছে। জোটগতভাবে না এলেও বিএনপির ভেতরের অনেকেই নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছেন। আমাদের কাছে খবর আছে, তারা অনেকেই প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনে অংশ নেবেন। শেষ মুহূর্তে পরিস্থিতি কোন পর্যায়ে যায়, তার ওপরও অনেক কিছু নির্ভর করছে। শেষ পর্যন্ত ছবিটা কোথায় যায়, দেখা যাক।
বিএনপির আরও কঠোর কর্মসূচি নিয়ে তিনি বলেন, বিএনপি যা যা করেছে এর চেয়ে কঠোর কর্মসূচির দৃষ্টান্ত পৃথিবীতে আর নেই। আগুন দিয়ে বাস পোড়ানো, পার্কিং করা গাড়িতে ঘুমন্ত চালককে হত্যা এবং হরতাল-অবরোধ এগুলো ২০১৩-১৪ সালের পুনরাবৃত্তি। নাশকতার চেয়ে আর কি কঠোর কর্মসূচি আছে?
জাতীয় ক্রিকেট দলের অধিনায়ক সাকিব আল হাসানের দল থেকে মনোনয়ন চাওয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ভারতের পশ্চিমবঙ্গে কত নায়ক-নায়িকা এমপি। তারা তো সরাসরি দল করেন না। ভারতের মতো বৃহৎ গণতান্ত্রিক দেশেও এটা আছে। আর সাকিব আল হাসান রাজনীতি করবেন, জনগণের সেবা করবেন। দেশের যে কোনো জায়গায় তিনি নির্বাচনে দাঁড়াতে পারেন।
এ সময় আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক অ্যাডভোকেট আফজাল হোসেন, কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সদস্য আনোয়ার হোসেনসহ কেন্দ্রীয় নেতারা উপস্থিত ছিলেন।
সুত্র: সমকাল অনলাইন
প্রতিদিনের খবরগুলো আপনার ফেসবুক টাইমলাইনে পেতে নিচের লাইক অপশনে ক্লিক করুন-